কলকাতা: ওয়াকফ নিয়ে উত্তাল রাজ্য থেকে গোটা দেশ। বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে অশান্তি, সংঘর্ষ। কিন্তু, অনেকেই জানেন না ওয়াকফ আসলে কী। ওয়াকফ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক…

১.ওয়াকফ কী : ওয়াকফ হল একটি সম্পত্তি যা আল্লাহর নামে দান করা হয়। একজন মুসলমান ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম স্বীকৃত – ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বা জনকল্যাণ হিতে এই সম্পত্তি দান করতে পারেন। একবার দান করলে তা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।

২. ওয়াকিফ কে? যিনি এই সম্পত্তি দান করেন তাঁকে বলে ওয়াকিফ আর সম্পত্তিটিকে বলে ওয়াকফ।

৩. ওয়াকফ নামা : ওয়াকফ নামা কী? ওয়াকফ নামা হল ওয়াকফ দলিল। এটি একটি লিখিত ডকুমেন্ট। ওয়াকফ সন্পত্তির সুবিধা কে কে পাবে অর্থাৎ কারা কারা এর বেনিফিশিয়ারি,তা এই Deed এ লেখা থাকে। এটি অনেক সময় লিখিত থাকেনা, তখন প্রচলিত ব্যবহার অনুযায়ী বেনিফিশিয়ারি ঠিক হয়।

৪. মুতোয়ালি কে : যিনি এই ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনা করেন তাঁকে মুতোয়ালি বলা হয়। এটি ওয়াকফ নামা বা Deed এ লেখা থাকে। Deed না থাকলে প্রচলিত ব্যবহার অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ড বা ওয়াকফ ট্রাইবুনাল এটি ঠিক করে দেয়।

৫. ওয়াকফ বোর্ড কী – প্রতিটি রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি পঞ্জীকরণ ও পরিচালনার জন্য রাজ্য স্তরে যে সংস্থা থাকে তাই হল ওয়াকফ বোর্ড।

৬. ওয়াকফ বোর্ডের সিদ্ধান্তে কেউ অখুশি হলে, তখন সেই ব্যক্তি ওয়াকফ ট্রাইবুনালে বিচার চাইতে পারে। এটি একটি Quasi Judicial প্রতিষ্ঠান।

৭. ওয়াকফ কাউন্সিল : কেন্দ্রীয় ভাবে এই সংস্থা সকল ওয়াকফ বোর্ড ও ওয়াকফের নীতি নির্ধারন করে।

ওয়াকফ আইনে কী কী পরিবর্তন এল? :

৮.২০১৩ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র মুসলমান ব্যক্তিরাই ওয়াকফ করতে পারতেন। ২০১৩ সালে সরকার সংশোধনী এনে বলল, যে কোনো ধর্মের লোক ওয়াকফ করতে পারেন।

৯.২০২৫ এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে – যারা অন্তত ৫ বছর ধরে ইসলাম কবুল করেছেন অর্থাৎ জন্ম সূত্রে যে কোনো মুসলিম এবং ধর্মান্তরিত মুসলিম যারা অন্ততঃ ৫ বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁরা এই ওয়াকফ করতে পারবেন।

১০.২০২৫ সংশোধনীতে বলা হয়েছে কোনো তপশীল উপজাতি দের জমি ওয়াকফ করা যাবে না।

১১.এতদিন পর্যন্ত Section -40 অনুযায়ী কোনো সম্পত্তিকে, একতরফা ভাবে ওয়াকফ বোর্ড, ওয়াকফ ঘোষণা করে নিয়ে নিতে পারতো। এই ভাবে কোথাও জেলেদের গ্রামকে বা কোথাও চার্চকে বা মন্দিরকে এক তরফা ভাবে, ওয়াকফ বোর্ড ওয়াকফ ঘোষণা করতে গিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে – বর্তমানে এই সেকশন তুলে দেওয়া হল।

১২.এতদিন পর্যন্ত ওয়াকফ সম্পত্তি সার্ভের কাজটি করতো সার্ভে কমিশনার – নতুন আইনে এই কাজটি করবে জেলা শাসক বা কালেক্টর।

১৩.এতদিন পর্যন্ত ওয়াকফ by Users ছিল। অর্থাৎ কোনো ডকুমেন্ট ছাড়াই কোনো জায়গায় মুসলিমরা নামাজ পড়লে, বা দরগা করলে, তা ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করা যেত – এখন থেকে ওয়াকফ ঘোষণা করতে গেলে মালিকানার দলিল দরকার।মালিকানার দলিল ছাড়া ওয়াকফ ঘোষণা করা যাবে না।

১৪. ওয়াকফ সম্পত্তি, কী ওয়াকফ সম্পত্তি নয় – এতদিনে এই নিয়ে শেষ কথা বলতো ওয়াকফ বোর্ড, তারপরে dispute দেখা দিলে ওয়াকফ ট্রাইবুনাল। এবং সীমিত ক্ষেত্রে হাইকোর্টে যাওয়া যেত –
বর্তমানে ওয়াকফ নির্ধারণে জেলা শাসক বা কালেকটরের ভূমিকা মুখ্য। বিশেষ করে সরকারি কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ করা হয়েছে কী না, তা জেলা শাসক ঠিক করবেন। ওয়াকফ সম্পত্তি ম্যানেজমেন্ট করে কিভাবে বেশি আয় করা যায় সেই ব্যাপারেও জেলা শাসকের ভূমিকা থাকবে। কোনো বিবাদের ক্ষেত্রে যে কেউ ট্রাইবুনালের রায়ে অসন্তুষ্ট হলে হাইকোর্ট যেতে পারবে।

১৫. পূর্বে ওয়াকফ ঘোষণার ক্ষেত্রে কোনো পাবলিক নোটিশ দেওয়া হত না। বর্তমানে ওয়াকফ হিসেবে নথিভুক্ত করতে গেলে পাবলিক নোটিশ দিতে হবে। তারপরে কেউ আপত্তি জানালে তার বক্তব্য শুনতে হবে। তারপরে তা নথিভুক্ত হবে ও রেকর্ডেড হবে।

১৬. পূর্বে ওয়াকফ নথিভুক্ত হত ওয়াকফ বোর্ডের কাছে। বর্তমানে তা অনলাইনে নথিভুক্ত করতে হবে। সবার সামনে উন্মুক্ত থাকবে এই পোর্টাল। এখানে উপযুক্ত মালিকানার নথি সহ নথিভুক্ত করতে হবে।

১৭. ওয়াকফ বোর্ড বা ওয়াকফ কাউন্সিলে কী পরিবর্তন এসেছে – হ্যাঁ এক্ষেত্রে দুজন নন মুসলিম ও দুজন মহিলা সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মূলত ওয়াকফ বোর্ডের কাজকে সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। আফগানি ও বরা সম্প্রদায়ের জন্য Representaion এর কথা বলা হয়েছে।

১৮ – হিন্দু বোর্ডের ক্ষেত্রে কী এরকম অহিন্দু সদস্য রাখার ব্যবস্থা আছে : ওয়াকফ বোর্ডের মত বা ওয়াকফ কাউন্সিলের মত কোনো সংগঠন হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত নেই। তামিলনাড়ু বা করনাটকের মত কিছু রাজ্যে মন্দিরের ট্রাষ্টি বোর্ড নিয়ন্ত্রণের সংস্থা থাকলেও, বেশিরভাগ রাজ্যে বা কেন্দ্রে এরকম কোনো সংস্থা নেই। যা আছে আঞ্চলিক স্তরে ট্রাস্ট বোর্ড বা সেবাইত।

১৯ ওয়াকফ বোর্ডের সম্পদ ও আয় কেমন : ওয়াকফ বোর্ডের মোট সম্পত্তি প্রায় ৯ লক্ষ এবং তার পরিমান ১০ লক্ষ একর জায়গা। বার্ষিক আয় হওয়ার কথা ৯ থেকে দশ হাজার কোটি টাকা। আর এখন আয় হয় বছরে দুশো কোটি টাকার মত। সেনাবাহিনী, ও রেলের পরেই ওয়াকফের সম্পদ। বেশিরভাগ সম্পদ ওয়াকফ বোর্ডের মদতে বেহাত ও লুঠ হয়েছে। আত্মসৎ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ওয়াকফ সম্পত্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের আয়ে ওয়াকফ বোর্ডের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেনা। সরকারকে অনুদান দিতে হয়। বর্তমানে ইমাম মোয়াজ্জিন ভাতা ওয়াকফ বোর্ড দিলেও, সেই টাকা তার আয় থেকে দেওয়া যায় না । সেই টাকা সরকার অনুদান হিসেবে বোর্ডকে দেয়।

২০. এই আইনে কী ওয়াকফ সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার সুযোগ আছে? বলে রাখি এই এই আইনে সরকারি সম্পত্তি ছাড়া, পূর্বে যা ওয়াকফ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে, সেই সব সম্পত্তি পূর্বের ন্যায় ওয়াকফ থাকবে।কেড়ে নেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই।

২১. এই আইনে বেনিফিসিয়ারি পরিবর্তন হচ্ছে কী,? না। এই আইনে আগের মতই সুবিধাভোগীরা সুবিধা পাবে। কেবল ম্যানেজমেন্ট এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।

২২. নতুন আইনে প্রতিবছর হিসেব ও অডিট করতে হবে।

২৩। নতুন আইনে কাদের অসুবিধে? এতদিন যারা ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে, ওয়াকফ সম্পত্তি লুঠ করতো, তাদের এতে বিপদ। তারাই সাধারণ মুসলিমদের ভুল বুঝিয়ে পথে নামিয়েছে।

এই লেখাতে একটু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কোনো আইনই বা কোনো রায়ই সকলকে তুষ্ট করতে পারবে না। দিনের শেষে আমাদের সংবিধানে আস্থা রাখতে হবে। Wisdom of Parliament এবং সব শেষে wisdom of Court এর উপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। এই নতুন সংশোধনী সাংবিধানিক কিনা তার মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে। আপাতত সেই দিকেই আমাদের নজর থাকবে।